ক্লিওপেট্রা, আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট- এদের কবর যে এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি, জানেন তো? তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, মিসরের শেষ রানী ক্লিওপেট্রার কবর বুঝি খুঁজে পাওয়া যাবে, অন্তত সেদিকেই এগোচ্ছেন একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ।
ক্লিওপেট্রার ইতিহাস বিশাল। সেই ইতিহাস এখন লিখতে যাব না, তবে তাকে নিয়ে ইতিহাসপ্রেমীদের আগ্রহের শেষ নেই। ক্লিওপেট্রাকে লোকে বলে অনিন্দ্য-সুন্দরী, কিন্তু এই আপেক্ষিক বিষয় যাচাই করার উপায় তো নেই আমাদের কাছে।
ভালো কথা, তিনি কিন্তু মারা যান যীশুর জন্মের মাত্র ৩০ বছর আগে। শাসন করেছিলেন ২১ বছর। তার মৃত্যুর পর মিসর হয়ে যায় রোমান সাম্রাজ্যের একটা রাজ্য। বাবা মারা যাওয়ার পর ক্লিওপেট্রা সিংহাসনে বসেন বটে, কিন্তু তিনি কিন্তু একা শাসক হননি! তার ভাই টলেমি (ত্রয়োদশ) তার সাথেই যুগ্মভাবে মিসর শাসন করতে লাগলেন। কিন্তু যা হবার তাই হলো, তাদের দ্বৈরথে গৃহযুদ্ধ বেঁধে গেল। সেটা খ্রিস্টপূর্ব ৫১ সালের কথা। ভালো কথা, ক্লিওপেট্রা কিন্তু তার এই ভাইকে বিয়ে করেছিলেন, তখন টলেমির বয়স ১০, আর ক্লিওপেট্রার ১৮ বছর।
ওদিকে নাটকে নতুন চরিত্রের প্রবেশ ঘটলো। রোমান শাসক জুলিয়াস সিজারের প্রতিদ্বন্দ্বী পম্পে যুদ্ধে হেরে পালিয়ে এলেন মিসরে। আশ্রয় নিলেন টলেমির কাছে, মানে ক্লিওপেট্রার ভাইয়ের কাছে। কেন? কারণ, তারা আগে থেকে মিত্র ছিলেন। টলেমি কী করলেন? পম্পেকে হত্যা করালেন। এরপর জুলিয়াস সিজার এলেন আর আলেকজান্দ্রিয়া দখন করে নিলেন, দেখলেন পম্পে নেই আর; তখন সুন্দর মতো ক্লিওপেট্রা আর টলেমির মাঝে মিল মহব্বর করানোর চেষ্টা করলেন।
কিন্তু কীসের কী? টলেমিকে বোঝানো হলো যে জুলিয়াস সিজার আসলে ক্লিওপেট্রার প্রেমে মশগুল, এইসব মিলমিশ আসলে চোখে ধুলো দেয়া হচ্ছে, সব ক্লিওপেট্রার পক্ষে যাবে। ক্ষেপে গিয়ে টলেমি ক্লিওপেট্রা আর সিজারকে প্রাসাদে বন্দী করেই অবরোধ করে ফেললেন।
জুলিয়াস সিজারকে বন্দী করা চাট্টিখানি কথা না। খুব দ্রুতই অবরোধের ইতি টানতে হলো, বিখ্যাত নীলনদের যুদ্ধে মারা গেলেন টলেমি। ক্লিওপেট্রা তার সৎবোন আরসিনো-কে নির্বাসন দিলেন, কারণ আরসিনো টলেমির সাথে আঁতাত করেছিলেন।
জুলিয়াস সিজার ঘোষণা দিলেন, ক্লিওপেট্রা এবার শাসন করবেন তার আরেক ভাইয়ের সাথে। সেই ভাইয়ের নামও টলেমি। চতুর্দশ টলেমি। ক্লিওপেট্রা তাকে বিয়ে করলেন, তখন এই টলেমির বয়স ১৩ বছর।
ওদিকে লোকে যা ভাবছিল, ঘটনা তাই হয়েছিল। লুকিয়ে লুকিয়ে জুলিয়াস সিজার আর ক্লিওপেট্রা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলেন। ক্লিওপেট্রা এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিলেন, সিজারের সন্তান, নাম রাখলেন সিজারিয়ন।
সিজারিয়নের বরাতে হোক আর যে কারণেই হোক, ক্লিওপেট্রা রোমে চলে গেলেন, দুটা বছর থাকলেন সিজারের ভিলা-তে। রোমান সম্রাজ্ঞীর মতো রানীর হালতে তার বাকি জীবন কেটে যেতেই পারত, কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! রোমান সিনেটররা মিলে খুন করলেন জুলিয়াস সিজারকে। তখন খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ সাল।
ক্লিওপেট্রা কী করবেন এবার? তিনি তার ভাই টলেমিকে খুন করিয়ে নিলেন। এরপর নিজের ছেলে সিজারিয়নকে রাজা ঘোষণা করলেন, এখন থেকে সিজারিয়নই হবে তার সহশাসক। তবে নতুন নাম হবে তার। আন্দাজ করতে পারছেন? 'টলেমি'। পঞ্চদশ টলেমি।
তারপর নীলনদের জল অনেক গড়ালো, রোমের রাজনীতিও অনেক আগালো। গণপ্রজাতন্ত্রী রোমকে রোমান সাম্রাজ্যে পরিণত করার পেছনে কৃতিত্বের দাবীদার যে রাজনীতিবিদ- মার্কাস অ্যান্টনিয়াস, যাকে আমরা আদর করে মার্ক অ্যান্টনি ডাকি- সেই মার্কের প্রেমে পড়লেন ক্লিওপেট্রা। কী কেন কীভাবে, সেই গভীর ইতিহাসে যাচ্ছি না। ভালোবাসার ক্লিওপেট্রার অনুরোধে সৎবোন সেই আরসিনো-কে খুন করালেন মার্ক অ্যান্টনি। আর ক্লিওপেট্রা থেকে অ্যান্টনি নিতে লাগলেন তার মিলিটারি ফান্ডিং। তাদের দুই ছেলে আর এক মেয়েকে তারা বিভিন্ন অঞ্চলের শাসক ঘোষণা করে দিলেন।
মার্ক অ্যান্টনিসহ যে তিনজন মিলে রোমান মৈত্রী (Second Triumvirate) গড়ে তুলেছিলেন, তাদের একজন ছিলেন অক্টাভিয়ান। মার্ক ঘুণাক্ষরেও জানতেন না যে এই অক্টাভিয়ান ভবিষ্যতে প্রথম রোমান সম্রাট হতে চলেছেন, তখন তার নাম হবে সম্রাট অগাস্টাস। মার্কের আরেক ঝামেলার কথা তো বলতে ভুলে গিয়েছি, তিনি তো অক্টাভিয়ানের বোন অক্টাভিয়াকে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু তালাক দেননি। অক্টাভিয়া তার চতুর্থ বউ। তালাক না দিয়েই তিনি জড়িয়ে পড়েছিলেন ক্লিওপেট্রার সাথে।
পরে অবশ্য মার্ক তালাক দিলেন বউকে। প্রাক্তন স্ত্রী অক্টাভিয়ার ভাই অক্টাভিয়ান (ভবিষ্যৎ রোমান সম্রাট) মার্কের মিত্রদেরকে রোম-ছাড়া করলেন, যুদ্ধ ঘোষণা করলেন ক্লিওপেট্রার বিরুদ্ধে।
মার্ক অ্যান্টনি আর ক্লিওপেট্রা সম্মিলিতভাবে লড়লেন অক্টাভিয়ানের রোমান বাহিনীর বিরুদ্ধে। সেটা খ্রিস্টপূর্ব ৩১ সালের কথা।
হারলেন অ্যান্টনি ও ক্লিওপেট্রা। অক্টাভিয়ানের বাহিনী মিসরে ঢুকে পড়লো।
অ্যান্টনি নিজের তরবারির আঘাতে আত্ম-হত্যা করলেন।
ক্লিওপেট্রা জানতে পারলেন অক্টাভিয়ান তাকে ধরে বিজয় মিছিলে প্রদর্শন করতে চান। তাই তিনি নিজের শরীরে বিষ প্রয়োগ করলেন, এরপর সেই বিষক্রিয়ায় মারা গেলেন। লোকে অবশ্য ভাবত তিনি সাপের কামড় খেয়েছিলেন ইচ্ছে করে, আসলে তা না।
অক্টাভিয়ান তার প্রাক্তন স্বামী মার্ক অ্যান্টনি আর ক্লিওপেট্রাকে একত্রে সমাহিত করার অনুমতি দিলেন। অন্য এক সূত্রে জানা যায়, অ্যান্টনির লাশ দাহ করা হয়েছিল।
তার মানে দাঁড়ায়, আমরা যদি ক্লিওপেট্রার কবর খুঁজে পাই, তাহলে তার সাথে অ্যান্টনির কবরও থাকতে পারে, যদি না আসলেই তাকে দাহ করা হয়ে থাকে।
তাদের কবর পাওয়া গেলে পাওয়া যাবে আলেকজান্দ্রিয়াতে। প্রত্নতত্ত্ববিদরা ধারণা করছেন, আলেকজান্দ্রিয়ার 'তাপ-অসাইরিস ম্যাগনা' ('দেবতা অসাইরিসের মহান সমাধি') শহরের মন্দিরে হয়তো পাওয়া যাবে। কিন্তু আরেক দল প্রত্নতত্ত্ববিদ বলছেন, মিসরীয়রা কখনও মন্দিরে কবর দিত না, তাই এখানে পাওয়ার কথা না।
সম্প্রতি সেখানে ১.৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সুড়ঙ্গ পাওয়া গিয়েছে (প্রত্নতত্ত্ববিদ ক্যাথলিন মার্টিনেজের নেতৃত্বে), যেটিকে মনে করা হচ্ছে ক্লিওপেট্রার কবর পাওয়ার পথে আরেকটি ধাপ হিসেবে। সেখানে ক্লিওপেট্রা ও আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের ছবিওয়ালা মুদ্রাও পাওয়া গিয়েছে।
কবর আসলেই পাওয়া যাবে কি যাবে না সেটা ভবিষ্যৎই বলে দেবে।
(সরলীকৃত ইতিহাস তুলে ধরার জন্য আগাম দুঃখপ্রকাশ করে নিচ্ছি।)
পুনশ্চ: মার্ক অ্যান্টনিকে বিয়ে করেছিলেন ক্লিওপেট্রা। কিন্তু তার আগের প্রেমিক জুলিয়াস সিজার অবশ্য ক্লিওপেট্রাকে বিয়ে করেননি, বরং ক্লিওপেট্রা যে তার রক্ষিতা সেটা কোনোদিন লুকাননি।
পুনশ্চ-২: যে টলেমির উপপাদ্য আপনারা পড়েছেন, সেই গণিতবিদও মিসরে জন্ম নেয়া, তবে সেটা ১০০ সালে। তিনি মারা যান ১৬৮/১৭০ সালে আলেকজান্দ্রিয়ায়। তবে তিনি রাজবংশের কেউ ছিলেন না।
This Article is collected from Science Bee (www.sciencebee.com.bd)
0 Comments
Thenks for your comment!!